সরকারি ব্যয়ের (বাজেট) গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে অপরিকল্পিত ঋণের দায়ভার সরকারকে নিতে হচ্ছে। ফলে সরকারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাজেট শৃঙ্খলাও রক্ষা করা যাচ্ছে না বলে অর্থ বিভাগ মনে করছে।
এ বিষয়ে রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) অর্থ বিভাগ থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে।
এরআগে গত শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের চলতি ২০২২ সালের আর্থিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদন (এফটিআর) প্রকাশ হয়েছে। প্রতিবেদনে আর্থিক স্বচ্ছতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের শর্ত পূরণকারী দেশগুলোর তালিকায় স্থান করতে না পারলেও শর্তপূরণে বাংলাদেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। আরো উন্নতির জন্য চারটি সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এই চার সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নীতি মেনে বাজেটের কাগজপত্র প্রস্তুত করা। সিএজি’র স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত ও পর্যাপ্ত জনবলের ব্যবস্থা করা। বাস্তব চিত্র, সুপারিশসহ বিস্তারিত নিরীক্ষা প্রতিবেদন যথাসময়ে প্রকাশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে সম্পাদিত চুক্তির মৌলিক তথ্যগুলো জনসমক্ষে এবং সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরেই অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেটের গুণগত মান নিশ্চিত নিয়ে পরিপত্র জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বাজেট বাস্তবায়নে সাধারণত অর্থবছরের প্রথমার্ধে ধীরগতিতে চলে। অর্থবছরের শুরুর দিকে বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে যেমন ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়, তেমনি বেতনভাতা ব্যতীত অন্যান্য আইটেমের বিপরীতে ব্যয়ের পরিমাণও কম থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, মেরামত সংরক্ষণ, নির্মাণ ও পূর্ত এবং মালামাল ক্রয়/ সংগ্রহের ক্ষেত্রে অর্থবছরের শেষ দিকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়ের গুণগতমান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। উপরন্তু বছরের শেষে এসে সরকারের অপরিকল্পিত ঋণের দায়ভার গ্রহণ করতে হয়। ফলে বাজেটে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা যায় না।’
এই শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য এবার অন্যান্যবারের মতো প্রতি তিন মাস অন্তর বাজেট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও ত্রৈমাসিকভাবে বাজেট বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ করা হবে। এতে আগামী ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাজেট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ও প্রান্তিক শেষ হওয়ার পরবর্তী এক মাসের মধ্যে বাজেট বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন অর্থ বিভাগে পাঠানোর জন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাজমা মোবারক স্বাক্ষরিত এই পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘সরকারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার একটি প্রধান কারণ রাজস্ব আহরণ ও সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকা। জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত বাজেট সুষ্ঠুভাবে সময়মতো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগাম পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন সম্ভব হলে অপরিকল্পিত সরকারি ঋণ এড়ানো এবং ঋণজনিত ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।’
পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘এ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বাজেটের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অর্থবছরের শুরুতে একটি বাজেট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, যথাযথভাবে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং বাজেট বাস্তবায়নের নিয়মিত পরিবীক্ষণ করা প্রয়োজন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ যাতে বাজেট বাস্তবায়নের একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও পদ্ধতিসহ ফরম করা হয়েছে। ওই নীতিমালা ও পদ্ধতি অনুসরণে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাজেট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা একান্ত জরুরি। ’
রাজস্ব আহরণ পরিকল্পনার বিষয়ে পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন আইটেমের বিপরীতে ধার্যকৃত লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে কোয়ার্টারভিত্তিক রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। কোনো আইটেমের রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে মৌসুমভিত্তিক হ্রাসবৃদ্ধির রেকর্ড থাকলে তা বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট আইটেমের বিপরীতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে।
ব্যয়ের পরিকল্পনায় পরিপত্রে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বেতন-ভাতাসহ যেসব আইটেমের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থ সাধারণত সমানুপাতিক হারে পরিশোধ/ব্যয়িত হয় সে সব আইটেমের বিপরীতে কোয়ার্টারভিত্তিক ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা সমানুপাতিক হারে নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে কর্মকর্তাদের বেতনের ক্ষেত্রে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির আর্থিক সংশ্লেষ বিবেচনায় রাখতে হবে। তা ছাড়া উৎসব ভাতা, শ্রান্তিবিনোদন ভাতা ও ছুটি নগদায়ন ভাতা বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ সংশ্লিষ্ট কোয়ার্টারে প্রদর্শন করতে হবে।
প্রত্যেক মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে পূর্ববর্তী মাসের সব ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে হবে। সে অনুযায়ী প্রত্যেক কোয়ার্টারে প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ প্রদর্শন করতে হবে। অর্থবছরের প্রথম কোয়ার্টার থেকেই মেরামত ও সংরক্ষণের কাজ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এমনভাবে শুরু করতে হবে যেন অর্থবছরের বিভিন্ন কোয়ার্টারে মেরামত ও সংরক্ষণ কাজের বিল মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণভাবে পরিশোধ করা যায় এবং অর্থবছরের শেষ কোয়ার্টারে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ বিল পরিশোধের চাপ সৃষ্টি না হয়।
পরিপত্রের বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন বিষয়ে পর্যালোচনা করার জন্য অর্থসচিব আগামি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এতে বাজেট বাস্তবায়ন বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে।
পরিপত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি আয়-ব্যয়ের একটি সুষ্ঠু ভারসাম্য আনার জন্য এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।