মোনায়েম খান, নেত্রকোণা : জেলা অঞ্চলের কৃষিজমির সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে এ অঞ্চলের কৃষিজমি সুরক্ষায় ৪৭টি দাবী সম্বলিত একটি স্মারক লিপি প্রদান করেছে কৃষিজমি সুরক্ষায় নাগরিক মঞ্চ এবং বেসরকারি গবেষণা উন্নয়ন সংস্থা বারসিক। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বরাবরে প্রেরিত স্মারকলিপিটি জেলা প্রশাসক, নেত্রকোনা’র কাছে জমা দেয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মোঃ শাহেদ পারভেজ, জেলা প্রশাসক, নেত্রকোনা, মামুন খন্দকার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), মো: নুরুজ্জামান, উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, নেত্রকোনা, কৃষিজমি সুরক্ষায় নাগরিক মঞ্চ, নেত্রকোনা’র আহŸায়ক অধ্যক্ষ আনোয়ার হাসান, সদস্য সচিব সহযোগি অধ্যাপক মোঃ নাজমুল কবীর সরকার, বারসিক’র আঞ্চলিক সমন্বয়ক ও পরিবেশবিদ মোঃ অহিদুর রহমান, হিমু পাঠক আড্ডার প্রতিষ্ঠাতা আলপনা বেগম, কবি ও কথাসাহিত্যিক সোহরাব উদ্দিন আকন্দ এবং বারসিক কর্মকর্তা রনি খানসহ আরো অনেকেই। জেলা প্রশাসক স্মারকলিপিটি গ্রহণ করেন এবং মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করেন। স্মারকলিপি প্রেরণ সম্পর্কে মঞ্চের আহŸায়ক অধ্যক্ষ আনোয়ার হাসান বলেন ‘সারাদেশের মতো নেত্রকোনাতেও প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্যহারে কমছে কৃষিজমি। এভাবে কমতে থাকলে ভবিষ্যতে আমাদেরকে বড়ো বিপদে পড়তে হবে। সরকারি কৃষিজমি ও ভূমি ব্যবহার আইন করছেন। সে আইনের খসড়ার উপর নেত্রকোনায় ১০টি জনমতামতসভা এবং গবেষণার প্রেক্ষিতে এ স্মারকলিপিটি তৈরি করা হয়েছে। আমরা আশা করছি আইনটি চ‚ড়ান্ত অনুমোদন করার আগে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হবে।’স্মারকলিপিতে উল্লেখিত দাবীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাবীগুলো নি¤œরূপ: ১। কৃষিজমি সুরক্ষায় পরিকল্পিত নগরায়ন ও গ্রাম ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।২। ভ‚মির শ্রেণি পরিবর্তন যেনো না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে যেনো সরকারি গো-চারণ ভ‚মি থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামের গোহাট(গরু মানুষ ও উৎপাদিত ফসল পরিবহনের জন্য যে গ্রামিন রাস্তা)৩। পাহাড়-বনকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।৪। আলোচ্য আইনটিতে(প্রস্তাবিত কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভ‚মিব্যবহার আইন) অপরাধীদের বিচার কোন আদালতে হবে তার উল্লেখ নাই। এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে।৫। কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভ‚মিব্যবহার আইনের (যা অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে সর্বস্তরের সতামতের জন্য) একটি জায়গায় ‘অনুর্বর ভ‚মি’ ও ‘উর্বর ভ‚মি’র উল্লেখ আছে। এই ‘উর্বর’ এবং ‘অনুর্বর’ কে ঠিক করবে? সেই কর্তৃপক্ষের উল্লেখ নেই। এই আইনের ধারা ৪ এর ১ (খ) এবং ১(ঙ) ধারা সংশোধন করতে হবে।৬। সরকারিভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করে আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। অনাবাদী জমিকে আবাদের আওতায় আনতে হবে।৭। ভ‚মির মালিকানা সুষ্ঠুভাবে নিরূপণ করতে হবে। দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকজন দ্বারা অতিসত্ত¡র একটি নিভর্‚ল ভ‚মি জরিপ করতে হবে।৮। আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিজমিকে অকৃষি খাতে ব্যবহার করা যাবে না।৯। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভ‚মি অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে।১০। কৃষিজমিতে কৃষি ফসল বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে প্রাকৃতিক কৃষি(মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রেখে,নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে যে কৃষি) উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।১১। নদী-খাল বিল সহ সবধরণের জলাশয় সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।১২। প্রত্যেকটি ইউনিয়নে কৃষিজমি সুরক্ষা আইনের প্রধান প্রধান ধারা গুলো এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের কৃষি অফিসার এর নাম্বার সংবলিত একটি করে বিলবোর্ড স্থাপন করা যেতে পারে।১৩। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। মাজারি(মধ্যবিত্ত) কৃষকদের জন্য বিনা জামানতে অন্তত ২-৩ লক্ষ টাকা কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।১৪। ফসলি জমিতে ইটভাটা নির্মাণ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। কৃষিতে কোন কারখানা করা যাবেনা।১৫। আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য আলাদা একটি সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষা নির্ধারণ করতে হবে।১৬। কৃষি, শিল্প, জলাশয়, বসতবাড়ি ইত্যাদি খাতে কত শতাংশ ভ‚মি সংরক্ষণ করতে হবে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারণ করে নিতে হবে।১৭। জমি রেজিস্ট্রির অনধিক এক সপ্তাহের মধ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জমির খারিজ নিশ্চিত করতে হবে।১৮। পাহাড়ি ঢল প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে, নদ-নদী-খাল-বিল খনন করতে হবে। হাওরকে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নিজেদেরকে সচেতন হতে হবে এবং সবাইকে সচেতন করতে হবে।১৯। দেশ থেকে অর্থ পাচার হলে এই প্রভাব কৃষিজমিসহ সকল ক্ষেত্রেই পড়ে। তাই অর্থ পাচার রোধ করতে হবে।২০। সমবায় ভিত্তিক কৃষির চর্চা করতে হবে। সে জন্য ইউনিয়ন ভিত্তিক কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।২১। শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাওর স্টাডিজ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার খুলে হাওর গবেষণার নিয়মিত প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।২২। অঞ্চল ভিত্তিক স্থানীয় উচ্চ ফলন হয় এরকম জাতের বীজ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। ইউনিয়নভিত্তিক খাদ্যগুদাম স্থাপন করতে হবে।২৩। আমাদের সীমান্ত অঞ্চলে যেখানে পাহাড়ি বালুতে জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওখানে আমরা সরকারি উদ্যোগে বালু সহনশীল ফসল চাষ করতে পারি কি না সেটা চেষ্টা করে দেখতে পারি।২৪। টপ সয়েল বিক্রি করা বন্ধ করতে হবে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।২৫। ধান কলের চিমনি এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।২৬। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ভ‚মি রূপ অনুযায়ী ধান গবেষণা করতে হবে।২৭। কৃষি উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয়ী করতে হবে। উৎপাদনের উপকরণগুলোর দাম কমাতে হবে। সিন্ডিকেট বন্ধ করতে হবে।
২৮। জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী-খাল-বিল গুলো খনন করতে হবে।২৯। নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সমবায় ভিত্তিতে প্রাকৃতিক কৃষি চাষের ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।৩০। ডেল্টা প্রকল্পের আওতা বাড়াতে হবে, হাওরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।৩১। কৃষিজমি সুরক্ষা আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আইন কে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য প্রচার করতে হবে। পার্ক তৈরী বন্ধ করতে হবে।৩২। হাওরের মাছে কৃত্রিম খাদ্য,রোটানলসহ সকলধরণের কীটনাশক, ভিটামিন ইত্যাদি প্রয়োগ বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।৩৩। কৃষিকে একটি লাভজনক জায়গায় না নিলে কৃষি জমির উপর মানুষের আর থাকতে ইচ্ছে করবে না।৩৪। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই অনেকে আইন মানতে বাধ্য হবে।৩৫। কৃষি জমি সুরক্ষায় জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হতে হবে। । জলাভ‚মি রক্ষা করতে হবে। নদ-নদী, খাল-বিল ইত্যাদি জলাশয় পুন:খনন করতে হবে। কৃষি কাজে ভ‚-উপরিস্থ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কোন প্রকার প্রাকৃতিক জলাভ‚মি লিজ দেয়া যাবে না।৩৬। হাওরাঞ্চলকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা যাবে না। হাওর খনন করে ও হিজল-কড়চ গাছ রোপণ করে মাছের প্রজনন সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। হাওরাঞ্চলের জীব বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য একটি আইন করতে হবে। হাওরে বাঁধ দেয়া বন্ধ করতে হবে , বাঁধ না দিয়ে হাওর বিল,নদী পুনঃখনন করতে হবে।৩৭। হাওর এবং পাহাড়ি এলাকায় উন্নয়নের সময় বিশেষজ্ঞ দল গঠন করতে হবে। সেখানে স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ত রাখতে হবে।৩৮। কোন উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য যদি কেউ উচ্ছেদ হয়, তাদেরকে পূণর্বাসিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।৩৯। ইজারা প্রথা বাতিল করে কার্ড প্রথা চালু করতে হবে।৪০। কৃষি জমিতে যেনো বালুর টেক তৈরি না হয় ,বালুরাখার ব্যবস্থা না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে।৪১। গ্রাম পর্যায়ে কৃষিকেন্দ্রিক ও কৃষিআইন বিষয়ে তথ্যের পর্যাপ্ত প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।৪২। কৃষি জমি সুরক্ষায় আরো স্মার্ট হতে হবে, মাটির নিচ দিয়ে সেতু, রাস্তা তৈরি করতে হবে।৪৩। এলাকার ফসলি জমি রক্ষায় ইউনিয়ন কমিটি করতে হবে।৪৪। হাওরাঞ্চলে শস্যাবর্ত প্রক্রিয়ায় ফসল চাষ করা যেতে পারে।৪৫। হাওরের পানি নামার গতিমুখে কোন ধরণের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। মিঠাপানির মাছসহ হাওরের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নৌপুলিশ মোতায়েন করা যেতে পারে।৪৬। কৃষিকাজে ভ‚-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবে, ‘পানি নীতি’ সংস্কার করতে হবে এবং মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।৪৭। বাড়ির পিছনের জঙ্গল সুরক্ষাসহ প্রাকৃতিক বন ভ‚মি সম্প্রাসরণের উদ্যোগ নিতে হবে।