সম্প্রতি ডলারের রিজার্ভ নিরাপদ রাখার জন্য ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে কারণে হঠাৎ করেই ১০৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এমন ঘোষণায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তেমনি নানামুখী প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
ছোট্ট একটি গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই- একদিন সন্ধ্যায় কেরানীগঞ্জে কাজ শেষ করে মোহাম্মদপুর বসিলা তিন রাস্তার মোড় দিয়ে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড হয়ে ধানমন্ডি ফিরছিলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। তাই গাড়ির ভিতরেই হালকা ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছিল। বসিলার র্যাব ক্যাম্প পার হয়ে বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড় দিয়ে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড ঢুকতেই হঠাৎ চোখে পড়লো রাস্তায় ফুটপাতের ওপরে গড়ে তোলা সারি সারি ভ্রাম্যমাণ দোকান। প্রতিটি দোকানে ক্রেতা আকর্ষণ করতে আলোকিত করে রাখা হয়েছে। এ যেন ঝলমলে এক নতুন রঙিন হাট। কিন্তু রাস্তার ওপর এসব ভ্রাম্যমাণ দোকানে এত আলোকসজ্জায় প্রতিটি দোকানে কীভাবে লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে?
এমন প্রশ্ন মনে আসতেই জানার আগ্রহ জন্মালো। কোথা থেকে এত বিদ্যুৎ এলো? কীভাবে তারা বিদ্যুতের সংযোগ পেল? নানামুখী প্রশ্ন যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন ড্রাইভারকে গাড়িটা রাস্তার একপাশে থামিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললাম। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা ফুটপাতের দোকানগুলো দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর মনে হলো, রাস্তার পাশে থাকা বিদ্যুতের খুঁটিগুলো থেকে লাইন নিচে নামানো হয়েছে। আশপাশে অনেক খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও কোনো বিদ্যুতের মিটার খুঁজে পেলাম না। অনেক খুঁজে দেখলাম নতুন এক ভয়ঙ্কর বিষয়। ভ্রাম্যমাণ এসব দোকানগুলোতে সরাসরি বিদ্যুতের খুঁটি থেকে সংযোগ নামিয়ে লাইট জ্বালাতে দেওয়া হচ্ছে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম। এর পিছনে বড় কোনো সিন্ডিকেট কাজ করে। না হয় সরকারের এমন ক্ষতি করে বিদ্যুতের হরিলুটে কীভাবে এসব চক্র মেতে উঠেছে? এই এলাকায় যেমন জনপ্রতিনিধি রয়েছে। তেমনি প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসব রাস্তা দিয়ে নিশ্চয়ই চলাচল করে। এমন হরিলুট তাদের কারো চোখে কি পড়ে না?
বিদ্যুতের এমন অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে এ হরিলুট শুধু রাজধানীর এই এলাকায় ঘটছে বিষয়টি তেমন না। রাজধানী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমন চিত্র। তাদের দেখার মনেহয় কেউ নাই। অথচ এদিকে সরকার বিদ্যুতের ভর্তুকি দিতে দিতে এখন ডলারের রিজার্ভ নিরাপদ রাখার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা একটি জাতীয় সঙ্কট হিসেবে আমাদের দেশে দেখা দিয়েছে। বিদ্যুতের এমন অবৈধ সংযোগ এখন রাজধানী ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও চলে গেছে। এমন অবৈধ সংযোগ বন্ধ করাতো দূরের কথা, এসব সংযোগ বন্ধে সংশ্লিষ্টদের কোনো পদক্ষেপই নেই। এমন অবৈধ সংযোগ দিয়ে বছরের পর বছর মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের পকেট ভারি করে বিদ্যুৎ ঘাটতি তৈরি করছে এসব অসাধু চক্র।
আজ মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) দেশের বেসরকারি একটি টিভির এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে ফুটপাতে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ নিয়ে ভয়ঙ্কর এক প্রভাবশালী চক্রের চিত্র। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর ফুটপাত ও রাস্তার ওপর গড়ে ওঠা দোকানে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ লাখ অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুতের বাতি জ্বলে। একটি বাতি থেকে দিনে গড়ে ২০ টাকা আদায় করা হয়। সে হিসাবে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে মাসে ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় প্রভাবশালী চক্র।
বিশেষ করে, শহর কিংবা গ্রামের উন্নত এলাকাগুলোতে আমরা ব্যাংকগুলোর ছোট ছোট এটিএম বুথ দেখি। যে বুথ-গুলোতে দিনরাত এসি চলতে থাকে। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টাই এসিগুলো বিরতিহীন চলতে থাকে। তাহলে বিদ্যুৎ কি সাশ্রয় হচ্ছে, নাকি অপচয়? এছাড়াও, রাজধানীসহ সারাদেশে যে হারে ব্যাটারি চালিত অটো-রিকশা, অটো-ভ্যানগাড়ি এবং থ্রি হুইলারের ব্যবহার কয়েকগুণ বেড়েছে।
সেগুলো যে এলাকায় গ্যারেজ গড়ে তুলে সংযোগ দিয়ে বিদ্যুতের মাধ্যমে চার্জ দেওয়া হয়। সে সংযোগগুলো আদৌ কি বৈধ? সে বিষয়ে কি সংশ্লিষ্ট এলাকার বিদ্যুৎ বিভাগ কখনো কাজ করে সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করে অবৈধ সংযোগের ব্যবহার কমাতে পেরেছে? সেটা কিন্তু এখনো পারেনি। বরং এমন অবৈধ হাজার হাজার সংযোগ দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। এদের ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ কখনো নেওয়া হয়েছে এমনটা শোনা যায়নি কখনো।
আমাদের দেশ শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। এটা আমাদের বিরাট অর্জন এবং প্রাপ্তি। তবে এ অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারও বেড়েছে। ঘরে ঘরে রাইস কুকার, ওয়াশিং মেশিনের ব্যবহার যেভাবে বেড়েছে- একইভাবে প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে আমাদের বিদ্যুতের ব্যবহার কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের সৌখিনতায় আবদ্ধ করে ফেলেছে।
বিদ্যুতের অপব্যবহারের কারণে বর্তমানে আমরা লোডশেডিংয়ের আওতায় চলে এসেছি। এখন বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ঘোষণা দিয়ে এলাকাভিত্তিক বিদ্যুতের লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে।
জ্বালানী সাশ্রয়ের জন্য সারাদেশে রাত ৮টার পর দোকানপাট বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সকল সরকারি এবং বেসকারি অফিসগুলোতে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে বলা হয়েছে। যেসব ধর্মীয় উপসনালয় আছে সেগুলোতে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে বলা হয়েছে। জ্বালানী সাশ্রয় করতে সপ্তাহে একদিন পাম্পগুলো বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এমন সঙ্কট কি আমাদের ভাবিয়ে তোলে না?
এক বছর আগে ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার কথা মহাসমারোহে ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশের সরকার। সেই উপলক্ষকে উদযাপনের জন্য বড় আয়োজনও করা হয়েছিল। বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আহমদ কায়কাউস কিছুদিন আগে এক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ এখন বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশ থেকে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্তের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন আর বিদ্যুতের ঘাটতি নেই। আমাদের বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়তো আছে, কিন্তু চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করতে পারছি না, সেই অবস্থা আর নেই। বিদ্যুতের সাশ্রয় করতে আমাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে না।’
এত সব পরিকল্পনা আমাদের হাতে থাকার পরও আমাদের এখন বিদ্যুতের ঘাটতি আমাদের কি ভাবিয়ে তোলে না? এখন স্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমরা আসলেই কি শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছি? আমরাও কি দেউলিয়ার পথে?
লেখক: ভাইস চেয়ারম্যান, সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটি ও মহাসচিব, বাংলাদেশ ক্যাবল টিভি দর্শক ফোরাম